আল-হাদিস

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা - কুরআন ও হাদিস শিক্ষা | | NCTB BOOK
22
22

হাদিস আরবি শব্দ। এর অর্থ কথা, বাণী। ইসলামের পরিভাষায় মহানবি (সা.)- এর বাণী, কর্ম ও তাঁর মৌন সম্মতিকে হাদিস বলা হয়। সাহাবিগণ মহানবি (সা.)-এর সামনে ইসলামী শরীআত সম্পর্কিত কোন কথা বলেছেন বা কোন কাজ করেছেন আর মহানবি (সা.) তা নিষেধ করেননি কিংবা নীরব থেকেছেন এটাকে বলা হয় মৌন সম্মতি।

মহানবি (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রথম দিকে কুরআনের সাথে মিলে যাওয়ার আশঙ্কায় হাদিস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তখন আরবের লোকদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ছিল প্রখর। তাঁরা যা শুনতেন তা-ই তাদের মুখস্থ হয়ে যেত। মহানবি (সা.) তাঁদেরকে হাদিস মুখস্থ করার প্রতি উৎসাহিত করেন। মহানবি (সা.) বলেন- 'ঐ ব্যক্তি খনা হবে যে আমার হাদিস শুনবে, সংরক্ষণ করবে এবং যেভাবে শুনেছে ঠিক সেভাবেই অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে। (তিরমিযি) মহানবি (সা.)-এর এ বাণীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সাহাবিগণ হাদিস মুখস্থ করেন। এবং তা যথাযথভাবে অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। মহানবি (সা.)-এর ইন্তিকালের পর খুলাফায়ে রাশিদীন ও উমাইয়া শাসনামলে দীর্ঘদিন এভাবে প্রধানত: হাদিস মুখস্থ করে সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া সাহাবিগণ হাদিস শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে হাদিসের প্রসার ও প্রচার করেন। বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে তাঁদের নিকট হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কোনো সাহাবি ও তাবেঈ মহানবি (সা.)-এর বহু হাদিস লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

হিজরি ১০০ সালে উমাইয়া খলিফা উমর ইবন আব্দুল আযীয সরকারিভাবে হাদিস লিখার হুকুম জারি করেন। পরবর্তীকালে হিজরি তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমস্ত হাদিস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন। এ সময় হাদিসের বেশ কিছু বিশুদ্ধ কিতাব সংকলন করা হয়। এর মধ্যে সিহাহ্ সিত্তাহ' বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। এ ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতেও হাদিস সংকলন অব্যাহত থাকে। আর এভাবেই আমরা মহানবি (সা.)-এর হাদিস লাভ করি।

 

হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

হাদিস ইসলামি শরীআতের দ্বিতীয় উৎস। কুরআন মাজিদের পরই সুন্নাহ বা হাদিসের স্থান। কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ ইসলামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। এতে ইসলামের আহকাম, মূলনীতি ও নির্দেশাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। আর এ সংক্ষিপ্ত নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করার জন্য মহানবি (সা.) প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতেন। তাঁর ও ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণই হচ্ছে হাদিস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। কুরআন মাজিদে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু দিনে রাতে কত ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে হবে, প্রতি ওয়াজে কত রাকআত পড়তে হবে, কিভাবে রুকু-সিজদাহ করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ কুরআনে নেই। অনুরূপভাবে কুরআানে থাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কত পরিমাণ দিতে হবে, তার কোন উল্লেখ কুরআন মাজিদে নেই। আল্লাহর হুকুম অনুসারে মহানবি (সা.) এ গুলোর বিস্তারিত নিয়ম কানুন বর্ণনা করেছেন হাদিসের মাধ্যমে। এ কারণেই কুরআনের ন্যায় হাদিসের গুরুত্ব অপিরসীম। তাই কুরআন বুঝতে ও সে অনুসারে আমল করতে হাদিস অপরিহার্য। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-

مَا الكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ، وَمَا نَهُكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا

'রাসুল তোমাদের যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।' (সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭)

মহানবি (সা.) হাদিসের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, 'আমি তোমাদের কাছে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা এই দুটি আঁকড়ে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।' (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)

 

অর্থসহ নৈতিক গুণাবলি বিষয়ক দুটি হাদিস

পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতও নির্দেশ যেমন মানুষকে সৎপথের সন্ধান দেয়, তেমনি রাসুলের হাদিসগু সমগ্র মানব জাতিকে সত্য, ন্যায় ও শান্তির পথে পারচালিত করে। অতএব আমরা বলতে পারি মানব জীবনে হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কথায় ও কাজে সৎ-সুন্দর ও মার্জিত থাকার নাম নীতি ও নৈতিকতা। মানব জীবনে নীতি ও নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। বলা হয়ে থাকে নীতিহীন মানুষ পশুর সমান। তাকে সকলে ঘৃণা করে। তার সাথে কেউ লেন-দেন ও চলা-ফেরা করে না। সে সমাজে মাথা উঁচু করে বসবাস করতে পারে না। পক্ষান্তরে নীতিবান মানুষকে সকলে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। সকলে তাঁর অনুকরণ করে। সকলে তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। আমাদের প্রিয়নবি (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম নীতির অধিকারী। কোন অনিয়ম তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সর্বদা নীতি ও আদর্শের পরিপূর্ণ অনুশীলন করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্র তথা উত্তম নীতি নৈতিকতার পরিপূর্ণতা দানের জন্য। মহানবি (সা.) পবিত্র হাদিসে মানব জাতিকে নীতি- নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। নিয়ে নীতি-নৈতিকতামূলক দুটি হাদিস অর্থসহ উল্লেখ করা হল। আমরা এগুলো শিখব এবং এর শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করব।

 

হাদিস-১

 

لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ وَلَا دِيْنَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ مُسْنَدُ أَحْمَد 

“যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না, তার ইমান নেই আর যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না তার দীন নেই অর্থাৎ সে প্রকৃত দীনদার নয়।' (মুসনাদ আহমাদ)

দুনিয়া এবং আখিরাতে সাফল্য লাভের জন্য একজন মানুষকে ভালো গুণাবলি অর্জন করতে হয়। যে গুণাবলি তাকে আল্লাহর কাছে এবং মানুষের কাছে পছন্দনীয় করে তোলে। আমানত রক্ষা করা এবং ওয়াদা পালন করা সেগুলোর মাঝে অন্যতম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমরা অনেকের সাথে অনেক ওয়াদা করে থাকি। সেই গুয়াদাগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। যদি আমরা ওয়াদা পালন না করি তাহলে মানুষের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে এবং আল্লাহর কাছে আমরা খারাপ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। ওয়াদা পালন না করার জন্য আল্লাহর কাছে আমাদের শাস্তি পেতে হবে।

একইভাবে কেউ যখন আমাদের কাছে কোনো কিছু আমানত রাখবে, আমাদের দায়িত্ব হলো সেই আমানতকে যথাযথভাবে রক্ষা করা। যদি আমানতের খেয়ানত করি অথবা আমানত রক্ষা না করি তাহলে আমাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাই আমরা ওয়াদা পালন করব এবং আমানত রক্ষা করব। মহানবি (সা.) মানব জাতিকে এই হাদিসের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মুমিন ও দীনদার হওয়ার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।

 

হাদিস-২

إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ بُخَارِي وَمُسْلِمٍ

“সত্য (মানুষকে) পুণ্যের পথে পরিচালিত করে। আর পুণ্য জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।' (বুখারি ও মুসলিম)

 

শিক্ষা

সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। প্রকৃত কথা, কাজ, বিষয়, অবস্থা ইত্যাদি গোপন না করে হুবহু প্রকাশ করাকে সত্যবাদিতা বলা হয়। সত্যবাদীকে সকলে পছন্দ করে, ভালোবাসে। সকলে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। আমাদের প্রিয়নবি (সা.) সত্যবাদী ছিলেন। তিনি জীবনে কোন মিথ্যা বলেননি। তিনি মানুষকে সত্য কথা বলা ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা সত্য মানুষকে সকল পাপাচার থেকে বিরত রাখে। সত্যবাদী লোক কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে না। সর্বদা ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। ফলে তার ইহকালীন জীবন যেমন সুন্দর ও সার্থক হয় তেমনি আখিরাতে জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে। যেহেতু সততা মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে এবং পুণ্যের পথে ধাবিত করে। আর পুণ্য জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। সুতরাং আমরা সর্বদা কথা ও কাজে সত্যনিষ্ঠ হবো এবং মিথ্যা পরিহার করব। তাহলেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব।

 

অর্থসহ মুনাজাতমূলক দুটি হাদিস

মুনাজাত মহান আল্লাহর একটি পছন্দনীয় ইবাদাত। মহান আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্কের সেতুবন্ধন হল মুনাজাত। আল্লাহ চান বান্দা যেন মুনাজাতের মাধ্যমে বেশি বেশি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। তিনি বান্দার মুনাজাত কবুলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন-

ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ

অর্থ : 'তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব।' (সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ৬০)

মহানবি (সা.) উম্মতের মহান শিক্ষক। তিনি বলেন, 'আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।' (ইবনে মাজাহ) তিনি মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। কোন পথের অনুসরণ করলে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল লাভ করতে পারবে তা তিনি হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহর কাছে কীভাবে মুনাজাত করতে হবে হাদিসের মাধ্যমে তা তিনি উম্মতকে শিখিয়েছেন। অসংখ্য মুনাজাতমূলক হাসি রয়েছে। এখানে আমরা দুটি মুনাজাতমূলক হাদিস অর্থসহ শিখব এবং এগুলোর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নিকট ভক্তিসহকারে মুনাজাত করব।

 

হাদিস ১ 

اللَّهُم إِنْ أَسْأَلُكَ الْهُدَى، وَالتَّقْىٰ وَالْعَفَانَ وَالْغِنى (مُسْلِم)

অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি সঠিক পথের দিশা, আল্লাহভীতি, চারিত্রিক নির্মলতা ও স্বচ্ছলতা।' (মুসলিম)

মহানবি (সা.) তাঁর উম্মতকে অসংখ্য দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন যেগুলোর মাধ্যমে তারা আল্লাহর কাছে তাদের প্রার্থনা জানাবে। এই হাদিসটি তার মাঝে অন্যতম। এই হাদিসে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো বান্দা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। প্রথমটি হলো হেদায়াত বা সঠিক, সরল পথের সন্ধান। যে পথে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে তাকওয়ার কথা। তাকওয়া হলো, সকল কাজ আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সম্পাদন করা। তৃতীয়ত বলা হয়েছে উত্তম চরিত্রের কথা। উত্তম চরিত্র মানুষের মহামুল্যবান সম্পদ। আর সবশেষে বলা হয়েছে স্বচ্ছলতার কথা। এই চারটি বিষয় যদি কোনো মানুষের মাঝে পাওয়া যায় তাহলে সে ই দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হবে।

 

হাদিস-২

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا إِبْنُ مَاجَه

'হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট উপকারী জ্ঞান এবং পবিত্র রিযিক প্রার্থনা করছি।' (ইবন মাজাহ)

জ্ঞান মানুষের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সব ধরনের জ্ঞান দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য উপকারী হয় না। কিছু জ্ঞান অর্জন কেবল সময় নষ্ট ছাড়া কোনো কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে না। এজন্য মহানবি (সা.) আমাদেরকে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন যেন আমরা আল্লাহর নিকট উপকারী জ্ঞান চাই। এমন জ্ঞান যা আমাদের দুনিয়া এবং আখিরাতকে সাফল্যমণ্ডিত করবে। একইসঙ্গে হাদিসে আল্লাহর নিকট পবিত্র রিযিক চাওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কারণ রিযিক পবিত্র না হলে বান্দার কোনো দোয়া আল্লাহ তা'আলা কবুল করেন না। তাই আমরা আল্লাহর নিকট উপকারী জ্ঞান এবং পবিত্র রিযিক চাইব যেভাবে হাদিস শরিফে শেখানো হয়েছে।

 

নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় হাদিস

সততা, সত্যবাদিতা, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা, উন্নত চরিত্র, দয়া-মায়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, পরস্পর সহযোগিতা -এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ। মানুষের জীবন ও সমাজকে সুন্দর করতে হলে এই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অনুসরণ অপরিহার্য। উত্তম চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির উন্নতি হতে পারে না। তাই আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য এ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি।

একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, উঠা-বসা, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি বলে। এইরূপ নৈতিকতা ও মানবিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বোত্তম লোক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র উত্তম।' (বুখারি ও মুসলিম)

নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ হলো একজন মানুষের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা অর্জন করলে তার জীবন হয় সুন্দর ও উন্নত। এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও ভালোবাসা। সমাজের সকলে এ আদর্শ অনুশীলন করলে সমাজ হয় সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিময় এক আবাসস্থল।

অন্যদিকে সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ না থাকলে সমাজে শান্তি থাকে না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে দয়া, মায়া, ঐক্য, ভালোবাসা ইত্যাদি সদগুণাবলির চর্চা থাকে না। মানুষ পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করে। ফলে সমাজে নানা অরাজকতা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়।

মহানবি (সা.)-এর হাদিস নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা পূর্বপাঠে হাদিসের পরিচয় লাভ করেছি। হাদিসের মাধ্যমে আমরা প্রিয়নবি (সা.) এর বাণী ও কর্ম সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি মানুষের সাথে কীরূপ আচরণ করতেন তা জানতে পারি। তাঁর উত্তম চরিত্রের কথা জানতে পারি। তিনি আমাদের জন্য কী দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তাও আমরা হাদিস পড়ে জানতে পারি।

হাদিস শরিফে প্রিয়নবি (সা.) আমাদের নানাবিধ নৈতিক ও মানবিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। স্নেহ, মমতা, দয়া, ক্ষমা, সাম্য, মৈত্রী, ভাতৃত্ব, ভালোবাসা, পরস্পর সহযোগিতা ইত্যাদি গুন অনুশীলনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। আবার পরনিন্দা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, চুরি-ডাকাতি করা, গালিগালাজ করা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা ইত্যাদি খারাপ কাজ করতে আমাদের নিষেধ করেছেন। হিংসা-বিদ্বেষ, পূর্ব-অহংকার, খোশামোদ-তোষামোদ ইত্যাদিও খারাপ অভ্যাস। এগুলো মানবিক আদর্শের বিপরীত। এগুলো নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে। এগুলো থেকেও বিরত থাকার জন্য মহানবি (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

 

إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ

অর্থ: 'আর তোমরা অবশ্যই মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে। কেননা মিথ্যা পাপ কাজের দিকে ধাবিত করে। আর পাপ কাজ জাহান্নামের পথে ধাবিত করে।' (মুসলিম)

 

সৎ গুণাবলির অনুশীলন ও অসৎ গুণাবলি থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আমরা উত্তম চরিত্রবান হতে পারি। এগুলো আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায়ও সাহায্য করে। এভাবে হাদিসের শিক্ষা আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

হাদিস শরিফে মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনচরিত ও উত্তম চরিত্রের আদর্শ বর্ণিত আছে। আমাদের প্রিয়নবি (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলেছেন,

 

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ

'আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।' (সূরা আল-কালাম, আয়াত: ৪)

 

মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি সবসময় নৈতিক ও মানবিক গুণাবালি অনুসরণ করতেন। তাঁর একটি উপাধি ছিল আল-আমিন। আল-আমিন অর্থ বিশ্বাসী, বিশ্বস্ত, সত্যবাদী। তিনি সবসময় সত্য কথা বলতেন। কথা ও কাজে সততা অবলম্বন করতেন। কেউ কোন কিছু আমানত বা গচ্ছিত রাখলে তিনি তা মালিকের নিকট যথাযথভাবে ফেরত দিতেন। তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না, ওয়াদা ভঙ্গ করতেন না, বিশ্বাসঘাতকতা করতেন না। ফলে তাঁর শত্রুরাও তাকে আল-আমিন বা বিশ্বাসী নামে ডাকত।

এভাবে দেখা যায়, সবধরনের সৎগুণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল, দয়াবান, অতিথিপরায়ণ, মিষ্টভাষী। তিনি অন্যায় ও অম্লীল কাজ কখনো করতেন না। সারাজীবন তিনি মানুষকে উত্তম চরিত্র সম্পর্কে হাতেকলমে শিক্ষা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ আদর্শ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার উজ্জ্বল প্রমাণ। প্রিয়নবি (সা.)-এর চরিত্র অনুসরণ করলে কখনোই নৈতিক ও মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হবে না। বরং এর দ্বারা আমরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারব। এজনাই আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

 

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ

অর্থ: নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ মধ্যে রয়েছে উত্তম অনুপম আদর্শ।' (সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১)

রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ হাদিস শরিফে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ। আমরা হাদিস পড়ে এগুলো জানব এবং সে অনুযায়ী আমল করব। তাহলে আমরা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।

 

ইসলামিক অনুষ্ঠানের আয়োজন

আমরা এখন পর্যন্ত ইসলামের যে বিধিবিধান সম্পর্কে জানলাম, তার মধ্যে অন্যতম হলো ইবাদাত যা আগের অধ্যায়ে আমরা জেনেছি। আর এই ইবাদাতের সর্বোত্তম উপায় হলো সালাত আদায় করা। আগের অধ্যায় থেকে আমরা পবিত্রতা এবং অপবিত্রতা সম্পর্কেও জেনেছি। এ অধ্যায়ে আরো জেনেছি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুরা, মুনাজাতের জন্য কিছু আয়াত এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস। এবার তোমাদের একটি বিশেষ কাজ করতে হবে। তোমরা ইবাদাত সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা যা জেনেছ বা শিখেছ সেই সবকিছু মিলিয়ে একটি ইসলামিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। সেই অনুষ্ঠানে তোমাদের বন্ধুদের কেউ কুরআন তিলাওয়াত করবে, কেউ হামদ-নাত উপস্থাপন করবে, কেউবা সালাতের ওযু, গোসল, তায়াম্মুমের যেসব নিয়ম শিখেছ সেগুলো দিয়ে বানানো কোনো পোস্টার প্রদর্শন করবে, আবার কেউবা কুরআন এবং হাদিসের বানী উপস্থাপন করবে। কেউ আবার সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে ফরয কাজগুলো কী সেগুলোও সবাইকে পোস্টার বানিয়ে দেখিয়ে বা মুখে বলে জানাতে পারো।

মানে হলো, তোমাদের একটি সুন্দর ইসলামি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে, যেখানে যেমন থাকবে তোমাদের নিজেদের আগে থেকে জানা ইসলামি কোনো উপস্থাপনা, একই সঙ্গে থাকবে ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা বইটি থেকে এই পর্যন্ত যা যা তোমরা শিখেছ সেসবেরও উপস্থাপনা।

তাহলে দেরি না করে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে দাও। আর এ বিষয়ে তোমাদের শিক্ষকের সহায়তা নাও । কবে কখন অনুষ্ঠানটি হবে, সেটি শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে নাও, আর বন্ধুরা সবাই নিজেদের কাজ ভাগ করে নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করে দাও!

তাহলে এখন তোমাদের কাজ হলো—

কাজ-১২: (ইসলামিক অনুষ্ঠানের আয়োজন)

  • অনুষ্ঠানে কে কী উপস্থাপন করবে তা শিক্ষকের সহায়তায় ঠিক করা।
  • অনুষ্ঠান উপস্থাপনের জন্য কুরআন তিলাওয়াত, হামদ-নাত ইত্যাদি অনুশীলন করা, কোনো পোস্টার দেখাতে চাইলে সেগুলো তৈরি করে ফেলা।
  • অনুষ্ঠানটি কীভাবে চলবে (অনুষ্ঠানসূচি) তা ঠিক করা।
  • ইসলামিক অনুষ্ঠান উপস্থাপন এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।

 

নির্দিষ্ট দিনে শিক্ষকের সহায়তায় সব বন্ধু মিলে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করবে। অনুষ্ঠানে তোমাকে যে দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করবে। তোমার বন্ধুদের কারও যদি কোনো সহায়তার প্রয়োজন হয়, তবে তাকে সেভাবে সহায়তা করবে। সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটি পালন করতে পারলে, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও তুমি অনেক কিছু শিখতে পারবে।

Content added By
Promotion